WELCOME TO MY BLOG SITE

WELCOME TO MY BLOG SITE

WELCOME TO MY BLOG SITE

WELCOME TO MY BLOG SITE

WELCOME TO MY BLOG SITE

PopUp

Thursday, September 14, 2017

দারিদ্রতা


>>দারিদ্রতা<<
.
-এইযে হুনছেন মিনু আজ ইলিশ মাছ দিয়া ভাত খাইতে চাইছে।আসার সময় একটা ইলিশ মাছ কিন্না নিয়াইসেন।
>আইচ্ছা,,বলেই রহিম মিয়া রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পরলো।
.
রহিম মিয়ার মুখে কষ্টের ছাপ।কারন সে জানে সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যা টাকা রোজগার করে এতে তার নুন আনতে পান্তা ফুরাই।একজন রিক্সা চালকের দিন এর চেয়ে আর কেমন হতে পারে?রহিম মিয়ার তেমন কোনো জায়গা জমি নেই,বাপ দাদার রেখে যাওয়া ভিটেমাটি টুকুই তার শেষ সম্বল।এতেই তার পরিবার নিয়ে থাকে।
.
বড় মেয়ে তুলি ছেলে মন্টু ছোট মেয়ে মিনু আর তার স্ত্রী রহিমা বেগম কে নিয়ে তার পরিবার।
.
মিনু বেশ কয়েক দিন ধরে অসুস্থ হয়ে পরেছে।মিনুর বয়স তেমন বেশি নয়,মাত্র সাড়ে ছয় বছর বয়স তার।এই অল্প বয়সে মেয়েটি ক্যান্সার নামক ভয়ানক ব্যধিতে আক্রান্ত্র হয়েছে।
.
রহিম মিয়ার ইচ্ছে ছিলো মিনুকে বড় কোনো হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাবেন।কিন্তু তার এই দারিদ্রতার কারনে তার এই অসুস্থ মেয়েটিকে চিকিৎসা করাতে পারেনি।সে চেয়েছিলো তার ভিটে মাটিটুকু বিক্রি করে মেয়েটাকে চিকিৎসা করাতে কিন্তু তাতেও তার মেয়েটির সুস্থ হওয়ার সম্ভবনা নেই উল্টো তার পরিবার নিয়ে পথে নামতে হবে তাই আর সেটা করা হয়নি।
.
এসব ভাবতে ভাবতে সে চলে গেলো রিক্সা নিয়ে।সারাদিন রিক্সা চালিয়ে যে টাকা রোজগার করলো সেটা নিয়ে সে মাছের বাজারে গেলো ইলিশ মাছ কিনতে।
.
>এই যে ভাই, এ মাছ টার দাম কতো?
-ছয়শো পঞ্চাশ টাকা।
>রহিম মিয়ার মনটা ছোট হয়ে গেল।তার সারাদিনের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে তো ইলিশ মাছের অর্ধেক দাম ও হয়ে উঠেনি।তাতেও সে ভীরু ভীরু স্বরে বললো,ভাই দুইশো টাকা দিবো।
>যান যান আপনার মাছ খাওয়া লাগবো না,মাছ বিক্রি হওয়ার পর আইসেন মাছের পানি নিয়া যাইয়েন,তাতেই মাছ খাওয়ার স্বাদ মিটে যাবে।
>ভাই আমার অসুস্থ মেয়েটা ইলিশ মাছ খাইতে চাইছে।আমি পরে টাকা টা দিয়া দিমু।
>যান তো।চিল্লাইয়েন না।নুন আনতে পান্তা ফুরায় হেয় আবার ইলিশ মাছ খাইবো।
.
এসব শুনে রহিম মিয়ার বুক কষ্টে হাহাকার করে উঠলো। এতোদিন পর তার মেয়েটা ইলিশমাছ খেতে তাইছে।কিন্তু টাকার অভবে আর দারিদ্রতার কারনে সে ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছে না।
.
চোখ বেয়ে পানি পড়ছে রহিম মিয়ার,চোখ মুছছে আর হাটছে।
>এইযে রহিম চাচা বাকি টাকা টা দিলেন না যে?(রহমত আলী মুদি দোকানদার)
-আর কয়দিন পর দিয়া দিমু বাজান।
>প্রতিদিন ই তো একই কথা কন।টেকা দেওয়ার তো নাম নাই।
-দিয়া দিমু বাজান।রাগ কইরো না।
>হুনেন,মিষ্টি কথায় চিরা ভিজবো না।টাকা দিয়া বাসায় যান।
-রহিম মিয়ার টুপলিতে মেয়ের জন্য ইলিশ মাছ কেনার টাকা দোকানদার কে দিয়া বললো বাবা দুইশো টাকা রাখো।বাকি টাকা টা পরে দিয়া দিমু।
>আইচ্ছা ঠিক আছে,যত্তসব ভিক্ষুকের দল।
.
রহিম মিয়া এ কথা শুনে আরো বেশি কষ্টে বেঙ্গে পরলো।দোকানদারের অপমান আর মিনুর জন্য ইলিশ মাছ কিনতে না পারার হতাশা নিয়ে রাত ১১ টায় বাসায় ফিরলো।
.
রহিম মিয়ার বাসায় ফেরার আওয়াজ পেয়ে মিনু বলে উঠলো মা বাজান আমার লিগা ইলিশ মাছ আনছে মা বাজান ইলিশ মাছ আনছে।
.
রহিম মিয়া মিনুর এ কথা শুনে মিনুকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো আর ইলিশ মাছ আনতে না পারার আফসোস আর ব্যর্থতার কথা মেয়ে কে বলতে লাগলো।
.
রহিম মিয়া মিনুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে
এতো কষ্ট করার পর ও তার জন্য ইলিশ মাছ আনতে না পারার ব্যার্থ গল্প বলতে লাগলো। গল্প শুনতে শুনতে মিনু তার বাবার কোলে কখন যে চিরতরে ঘুমিয়ে পরলো কেউ বুঝতেই পারলো না।কিরে মা মিনু ঘুমিয়ে গেলি নাকি?বারবার ডাকার পরও কোন জবাব নেই। সবার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে মিনু চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে।এদিকে রহিম মিয়া, রহিমা বেগম আর তার দুই ছেলে মেয়ে মিনুর চলে যাওয়া দেখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।রহিম মিয়া শোকে পাথর হয়ে গেল আর রহিমা হয়ে গেলো পাগলের মতো।আর তাদের সংসারটা আরো বেশি হাহাকারে ভরে উঠলো।
.
বিঃদ্র:-আমাদের আসেপাশে এমন অনেক পরিবার আছে,রহিম মিয়ার পরিবারের মতো।তারা তাদের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো পূরন করতে পারে না,ছেলে মেয়ের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে পারে না।মিনুর মতো মেয়েগুলো অকালে চলে যায় না ফেরার দেশে।আসুন আমরা তাদের পাশে দাড়াই,তাদেরকে অপমান অবহেলা না করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।

Famous Person Speech 009

অসৎ লোক কাউকে সৎ মনে করে না,
সকলকেই সে নিজের মতো ভাবে,,,,।
____হযরত আলী (রাঃ)

Famous Person Speech 008

আমরা যখন আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ভুলে গিয়ে বিপথগামী হই তখনই সত্যিকারের অকৃতকার্যতা আসে। - জ্যুকুলিন মিলার

অন্তিম


অন্তিম

বাসে উঠতেই মনে হলো কোনো এক
ভাসমান জলসা সিরিয়ালের ভেতরে
ঢুকে গিয়েছি। মহাভেজাল পর্ব।
বাসের সামনের দিকটায় ও ঝগড়া
হচ্ছে, পেছনের দিকটায় ও ঝগড়া
হচ্ছে। মধ্যিখানে বসা কিছু উৎসুক
মানুষ গলা বাড়িয়ে দু'দিকের ঝগড়ার
মধ্যে কোন দিকের ঝগড়া দেখবে তা
নিয়ে কনফিউশনে আছে। তারা
কিছুক্ষণ সামনে তাকাচ্ছে, কিছুক্ষণ
পেছনে। আর কিছুক্ষণ ড্রাইভারকে,
বাস টা এখনো চলছেনা কেন ইস্যুতে
অবস্থান করে যথেষ্ট ভদ্র ভাষায় ধুয়ে
দিচ্ছে। আমি মজা পেলাম। বাসের
সামনের দিকে ঝগড়া করছে একটি
বয়স্কা মহিলা আর একটি তরুণী। একটু
পা বাড়িয়ে সামনে দাঁড়াতেই
ঝগড়ার মুল বিষয়টা ধরতে পারলাম।
ঝগড়া হচ্ছে জানালা নিয়ে। বৃদ্ধা
জানালার পাশে বসেছেন এবং সেটা
খোলা রাখতে চাইছেন, তরুণী
জানালা বন্ধ রাখতে চাইছেন। আমি
তরুণীর দিকে তাকালাম। তরুণীর নাক
লাল, ফর্সা হাতে বসুন্ধরা টিস্যুর
আস্ত একটা প্যাকেট, পাঁচ ছয় সেকেন্ড
পর পর নাক মুছছেন, গলার স্বর ভাঙ্গা
ভাঙ্গা.. উড়না টা গলায় এমনভাবে
প্যাঁচানো যাতে বাতাস না লাগতে
পারে। তরুণী অসুস্থ.. চোখে প্রচন্ড
রাগ। রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে
আমি সিউর হয়ে গেলাম, যেকোনো
ঝগড়ায় এই মেয়ে শুধু চোখ লাল করে
চেয়ে থাকেনা..। অধিকাংশ সময়
ঝগড়া করা মানুষটির মুখের যেকোনো
এক অংশে থাপ্পড় বসিয়ে লালচে করে
ফেলে। আমি বৃদ্ধার দিকে তাকালাম
ভয়ে ভয়ে। নেহাত বয়সের কারণে
বৃদ্ধা এখনো রাগী অসুস্থ তরুণীর পাশে
সিটে হেলান দিয়ে বসে নির্ভয়ে
ঝগড়া করতে পারছে। আমার মন টা
মনে মনে তরুণীর সাইড নিলো, উহু..
সুন্দরী তরুণী বলে নয়। বেচারীর
ঠান্ডা লেগেছে। জানালা টা বন্ধ
থাকলেই ভালো। বৃদ্ধার জানালা
খুলে রাখার পেছনের কারণ টা আরো
বেশি বিরক্তিকর। বাসে উঠলে বৃদ্ধার
বমি পায়, জানালা খোলা থাকতেই
হবে। উপায় নেই। রাগী অসুস্থ এই
তরুণীর উপর আমার মায়া হলো ভীষণ।
আচ্ছা, কি এমন হতো? একটু আগেই যদি
বাসে উঠতাম, তবে এই ঝামেলাময়ী
বৃদ্ধার জায়গায় আমি বসতাম হয়তো।
তারপর তরুণী এসে পাশে বসে একবার
যদি বলতো, জানালা বন্ধ থাকুক..
তবে জানালা বন্ধ ই থাকতো। খুলতাম
না আর। স্বয়ং জীবনানন্দ এসে ও যদি
কানের কাছে কবিতা গুজে দিতো,
তবুও খুলতাম না। আমি সবচেয়ে বেশি
ভালোবাসি জীবনানন্দ, তারপরে
রুদ্র। আচ্ছা, এই মেয়ে কি কবিতা
পড়ে? জীবনানন্দ পড়েছে কখনো? কে
জানে?
বাসের পেছনের দিকের ঝগড়ায়
অংশগ্রহন করেছেন দু'জন ব্যক্তি।
একজন বাসের হেল্পার, অন্যজন
মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। ভদ্রলোক কালো
রঙের শার্ট পরেছেন, শার্টের
বামদিকের কলারে চুন লেগে আছে..।
সম্ভবত বাইরে পান খেয়েছেন কোথাও
দাঁড়িয়ে, হাতে করে চুন নিয়ে মুখে
দেয়ার সময় কলারে কিছুটা পড়ে
গেছে, ভদ্রলোকের খেয়াল নেই।
এইখানে ঝগড়া হচ্ছে, তবে জানালা
নিয়ে নয়। সিট নিয়ে। ভদ্রলোকের
হাতে একটা মাঝারি সাইজের শক্ত
কাগজের বাক্স। বাক্সটা ওজনে একদম
ভারী নয়, হালকা, যেন মনে হয়
বাক্সের ভেতরে কিছু নেই ই। তবে
ওজন না থাকলেও বাক্সের সাইজ টা
বাসের সিট থেকে সামান্য বড়। ফলে
ডানদিকের একটা সিটে বাক্সটা
বসানো যাচ্ছেনা, দু'টা সিট লাগছে।
ভদ্রলোক একঘুঁয়ে টাইপের। চাইলে
বাক্সটা নিচেও রাখতে পারেন, নইলে
বাসের বাইরে বামদিকে নিচে বাক্স
টাক্স রাখার জায়গা আছে, সেখানেও
রাখতে পারেন। না..! তিনি বাক্সটা
এখানেই রাখবেন এবং এই সিটেই
রাখবেন। এতে অবশ্য ঝগড়া বাঁধার
কিছু নাই। তবে ঝগড়া টা কি নিয়ে?
যে সিট নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে, তার
বামদিকে দু'টো সিট খালি। বাসে
আর সিট নেই। আমি সিটের সামনে
যেতেই ভদ্রলোক ঝগড়ার মধ্যেই আমায়
উদ্দেশ্য করে বললেন,
-- জানালার পাশে বসো। এইটা
আমার সিট।
বলেই আবার ঝগড়ায় মনোযোগ দিলেন।
আমি ঝগড়ার মুল কারণ টা ধরতে
পারছিনা। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে
তাদের ঝগড়া শুনলাম। হেল্পার দের
মুখের ভাষা ভয়ংকর খারাপ হয়, ঝগড়া
বাঁধলে ঐসব ভাষা ফুরফুর করে মুখ
দিয়ে বের হয়ে আসে। কিন্তু এই
হেল্পার টা প্রচন্ড ধৈর্য নিয়ে ঝগড়া
করছে, যথেষ্ট ভদ্রতা দেখিয়ে। ঝগড়ার
কারণ হচ্ছে, ভদ্রলোকের বাক্সটা
দুইটা সিট দখল করেছে, হেল্পার শান্ত
স্বরে ন্যায্য ভাড়া দাবী করেছেন,
ভদ্রলোক কে দুইটা সিটের ভাড়া
দিতে হবে। ভদ্রলোক চোখ মুখ লাল
করে গলার রগ ফুলিয়ে বলেছেন,
-- এইগুলা সিট? ছোট ছোট! (ছোট ছোট
বলার সময় ভদ্রলোক দু'টো হাতের
সবগুলো আঙ্গুল জড়ো করে গোলরকম
কোনো কিছু একটা দেখালেন!)
নিজেরাই বসতে পারিনা আরাম
করে। এই বাক্স এক সিটেই এঁটে যায়,
তোদের বাসে দুইটা সিট লাগতেছে।
কেন? আমি একটা সিটেরই ভাড়া
দিবো। আমার কাছে টাকার গাছ
নাই। তোদের বাসের সিট ছোট হইলে
আমার কি করা....?
প্রায় তেরমিনিট ঝগড়ার পর হেল্পার
হাল ছেড়ে দিয়ে হাঁটা দিলো বাসের
সামনের দিকে। ভদ্রলোক বিজয়ী
ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালেন,
মুখে হাসি। তারপর পাশে এসে
বসলেন। বসে বললেন,
-- ছোট ছোট বাচ্চাদের খেলনার
মতো সিট। দাম ষাট, সত্তর।
হারামজাদার দল। একটা সিটেই
বাক্সটা এঁটে যায়, হারামজাদার
বাসে দুইটা সিটেও হচ্ছেনা...!
আমি চুপ করে মাথা দুলিয়ে ইশারায়
জানাই "আপনার সাথে আমি একমত!"
রাগান্বিত কিংবা ভয়ংকর ঝগড়ুটে
মানুষের যেকোনো কথায় একমত পোষন
করা বুদ্ধিমানের কাজ। আমি
বুদ্ধিমান হওয়ার চেষ্টায় আছি।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি
হাসলেন, আমি একটু চমকালাম। কেন
জানিনা গায়ের লোম খাড়া হয়ে
গেলো হাসিটা দেখে। আজকাল এমন
হচ্ছে। বুঝতে পারছিনা। মেকি হাসি
দেখলেই কি এমন হয়, নাকি কোনো
একটা গোপন মানসিক সমস্যায় ভুগছি,
ঠিক বুঝতে পারছিনা। ভদ্রলোক হাসা
বন্ধ করে ডানপাশের সিটে রাখা
শক্ত কাগজের বাক্সটার দিকে
তাকিয়ে আছেন। খেয়াল রাখছেন,
বাক্সে কেউ হাত দেয় নাকি!
বাক্সের ব্যাপারে ভদ্রলোক
কড়ারকমের দায়িত্ববান। আমি চুপ
করে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে
রইলাম। বাস ছাড়ছে তখন, জানালা
দিয়ে বাতাস ঢুকছে, আমার ঘুম
পাচ্ছে। ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছেন বাক্সের দিকে,
বাক্সের ভেতরে আছেটা কি?
........
-- আমার নাম নাসির। নাসির
হোসেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের
একটা প্লেয়ারের নাম ও এইটা।
নাসির নামের মানুষগুলার কপাল টাইট
হয়। মানে ভাগ্য তাদের সহায় হয়না।
আমি এই নামে আমার পুরো লাইফে
অসংখ্য মানুষ দেখেছি, সবারই কপাল
টাইট....!
নাসির সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে
থেকে পরিচয়টা দিলেন এইভাবে,
আমি হাত বাড়ালাম হ্যান্ডশেকের
জন্যে। বাস তখন এ.কে খান ফেলে
এসেছে। নাসির সাহেব এখন রেগে
নেই, মুখ হাসি হাসি। কপাল টাইট
বলার সময় ও মুখে হাসি ধরে
রেখেছেন যেন কপাল টাইট হওয়াটা
একটা মজার ব্যাপার। এখন তার হাসি
দেখে অদ্ভুত লাগছেনা, স্বাভাবিকই
মনে হচ্ছে। কেউ হাসিমুখে কথা বললে
তার সাথেও হাসিমুখে কথা বলা
ভদ্রতা, আমি বুদ্ধিমান এবং
একিইসাথে ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করছি।
যদিও একিইসাথে দু'টা হওয়া সম্ভব না
সম্ভবত। বুদ্ধি বাড়লে অহংকার বাড়ে,
যদিও বুদ্ধিমান রা সেটা প্রকাশ
করেন না। অহংকার থেকে জন্ম নেয়
যে কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার
মানসিকতা টা.. বিনয় ধীরে ধীরে
মরে যায়..! আচ্ছা, এই নাসির হোসেন
কি অহংকারী টাইপের কেউ? মনে
হয়না! অহংকারী মানুষগুলো এতো
হাসিমুখে বাসের পাশের সিটের
অচেনা মানুষের সাথে গল্প করতে
আগ্রহী হন না। আমি হ্যান্ডশেক
করতে করতে বললাম,
-- আমি নীল। পুরো নাম নীলাভ।
মেয়েলি নাম। নামের প্রথম
অক্ষরদু'টো তাই বলে! তবে আমার কিছু
যায় আসেনা। বাবার দেয়া নাম।
আমার সাহিত্যমনা বাবাকে আমি
প্রচন্ড ভালোবাসি, সন্মান করি, আর
তার দেয়া নামটাকেও!
নাসির সাহেব হাসলেন। বললেন,
-- নামটা সুন্দর। তবে কষ্ট কষ্ট। নীল
রঙটা কষ্টের রঙ।
-- আপনি নাম নিয়ে খুব ভাবেন?
-- হুম। মাঝে মাঝে চিন্তা করি।
ভাবি। আমরা নামগুলোকে ছেলে
মেয়ে আলাদা করে দেখছি! কেন?
ধরো.. জোৎস্না। সরি, তুমি বলছি।
ভেবোনা বয়সে ছোট এজন্যে তুমি
বলছি, আসলে আমার অভ্যেসটাই এমন।
কিছু মনে করোনা। যেটা বলছিলাম,
ধরো জোৎস্না নামটা। নামটা শুনলেই
তোমার মাথায় চলে আসবে, এটা একটি
মেয়ের নাম। রাত্রি, জোৎস্না, বৃষ্টি..
এইগুলোকে কেন আমরা মেয়েলিরুপে
দেখি? আর আকাশ, রোদ, মেঘ
এইগুলোকে কেন আমরা ছেলেরুপে
দেখি..?
আমি চিন্তায় পড়লাম। আসলেই তো।
এইভাবে কখনো ভাবা হয়নি! এমন
কেন? নাসির সাহেব ডানদিকের
সিটে রাখা তার বাক্সের দিকে
আরেকবার তাকিয়ে চোখ এদিকে
ফিরিয়ে বললেন,
-- আমার একটা ছেলে আছে। ক্লাস
সিক্সে পড়ে। নাম অপু। নামটা
আমারই দেওয়া। এই নামের একটা
ব্যাপার আছে। এই নাম শুনে মানুষের
মাথায় একটা কনফিউশন কাজ করে।
তোমায় যদি না বলতাম, অপু আমার
ছেলের নাম। তবে তুমিও নামটা শুনে
কল্পনা করতে, এটা কি ছেলের নাম,
নাকি মেয়ের? কনফিউশন কাজ
করতো। ঠিক না..?
আমি মাথা নাড়লাম। ঠিক। আসলেই
নামটা এমন। নাসির সাহেবের দেখছি
নাম সম্পর্কে প্রচুর আগ্রহ। একটা ধাঁধা
জিজ্ঞেস করলে কেমন হয় তাকে?
নাসির সাহেব পকেট থেকে মোবাইল
বের করে মাথা নিচু করে স্ক্রীনে কি
যেন খুঁজছেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-- আচ্ছা, এমন একটি সাত অক্ষরের
নাম বলতে পারবেন যেটা বামদিক
থেকে ডানদিক পড়লে যে নাম, আবার
উল্টা দিক থেকে পড়লেও একিই নাম।
নাসির সাহেব মোবাইলের স্ক্রীন
থেকে চোখ না সরিয়ে আমায় বললেন,
-- অপুর মায়ের সাথে আমার কিভাবে
দেখা হয়েছে শুনবে?
আমি মনে মনে হাসলাম। নাসির
সাহেব ধাঁধার উত্তর জানেন না। তাই
প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছেন। থাক। না জানতে
চাইলে উত্তরটা জানাবোনা। বললাম,
-- অবশ্যই শুনবো।
-- একটু অপেক্ষা করো...
অপেক্ষা করো, বলে নাসির সাহেব
অনেকক্ষণ ফোনে কাকে যেন
বোঝাতে লাগলেন, তিনি যাচ্ছেন
ওখানে, এবং ফুটবল নেয়া হয়েছে তার
জন্যে। আমার কেন জানি মনে হলো
ফোনের ওপাশে মানুষটি নাসির
সাহেবের স্ত্রী। অপুর আম্মু। নাসির
সাহেব যখন কথা বলছেন, তখন আমরা
কর্নেল হাট পার হচ্ছি। এই জায়গাটার
নাম কর্নেল হাট হলেও লোকে বলে
কর্নার হাট। বাংলাদেশের মানুষ
ঠিক কোন কারণে মানুষের এবং
জায়গার নাম এতো বিকৃত করে ফেলে,
জানা নেই আমার। একটা যুক্তি
থাকতে পারে অবশ্য এর পেছনে।
বাংলা ভাষাটার জন্মই হয়েছে
বিকৃতির মাধ্যমে। নাম বিকৃত করার
পেছনে হয়তো, এই যুক্তি যথার্থ।
নাসির সাহেবের ফোনের ওপাশের
মানুষটিকে ঐ দু'টি কথা বোঝাতে
প্রায় সতেরো-বিশ মিনিট লেগে
গেলো। ফোন রেখে আমার দিকে
তাকিয়ে একটু হাসলেন তিনি, তারপর
বললেন,
-- ফুটবল। আমার লাইফের অনেকটা
অংশ জুড়ে এই চারটে অক্ষরের শব্দটি
আগাগোড়ায় মুড়ে আছে। ছোটবেলা
থেকেই প্রচুর ফুটবল খেলতাম। পছন্দের
খেলা ছিলো ও একটাই, ফুটবল। অপুর
আম্মুর নাম তাসনুভা। তাসনুভার
সাথে আমার দেখা হয় গ্রামেই.. বড়
বাজারের একটি দোকানে, ফুটবল
কিনতে গিয়ে। সে ও ফুটবল কিনতে
এসেছিলো। যদিও পরে জেনেছিলাম
সে আসলে ফলো করছিলো আমায়, আর
ফলো করতে করতেই দোকানে ঢুকে
পড়েছিলো। যাইহোক, আমি তাসনুভা
কে চিনতাম। তবে ছোটবোন হিসেবে।
ওর সাথে আমার বয়সের গ্যাপটা
ভীষণরকম বেশি ছিলো। তাসনুভা
সম্পর্কে বলি। এই বয়সী মেয়েরা প্রায়
সময় প্রেমে পড়ে সমবয়সী কোনো
ছেলের, হতে পারে সেটা ছোটবেলার
বন্ধু, ক্লাসমেট অথবা আত্মীয়ের মধ্যে
কেউ। কিংবা একেবারে অপরিচিত।
যেটাই হোকনা কেন, এইখানে একটা
বয়সের ব্যাপার কাজ করে। বয়সে ছোট
কারো প্রেমে তো পড়বেনা, বয়সে খুব
বেশি এমন কারো ও প্রেমে পড়বেনা।
আসলে এই বয়সী মেয়েরা প্রেমে
পড়েওনা, পড়তে চায়না, ভীষণরকম চায়
দুরে থাকতে.. কিন্তু প্রেম ঠিকিই
এসে পড়ে, একদম হুড়মুড় করে পড়ে।
আবেগ আগাগোড়া বেঁধে দেয়
মেয়েকে, মেয়ে ভালোবাসে।
তাসনুভা কেমন যেন! পৃথিবীর সবচেয়ে
বেশি পরিমাণ আবেগ নিয়ে
জন্মেছিলো বলেই হয়তো মেয়েটি
আমার প্রেমে পড়েছিলো। যেমন
তেমন প্রেম নয়। আমি জব করি
চিটাগাং শহরে, সে আমার পাশের
গ্রামেই থাকতো। আর অপেক্ষায়
থাকতো, দু'য়েক মাস পর কখন আমি
বাড়ি আসি। তারপর সারাদিন ফলো
করতো আমায়। যেখানে যাই, সে
আসবে পেছন পেছন। জেদী, একরোখা,
আবেগী আর পাগলী টাইপের এই
মেয়েটি তখন এইচ এস সি দিয়ে
ফেলেছে। রেজাল্টের অপেক্ষায়।
........
-- তাসনুভার সাথে আমার বিয়ে হয়
ওর রেজাল্টের দিন ই। দুইহাতে
ব্যান্ডেজ নিয়ে। হাতে এগারো টা
আঁচড় দিয়েছিলো ব্লেড হাতে নিয়ে।
হাসপাতাল থেকে যেদিন রিলিজ
করলো, তার আগের দিনই আমার বাবা
মা আর ওর বাবা মা আলাপ আলোচনা
কথাবার্তা শেষ করে বিয়ের ব্যবস্থা
করলেন। ফুলশয্যার রাতে তাসনুভা
আমায় প্রথম কথাটি কি বলেছিলো,
জানো? বলেছিলো, "আমরা কখনো
বাচ্চা নিবোনা। বাচ্চা নিলে অপুর
প্রতি মায়া কমে যাবে হয়তো আমার।
এটা একটা নিষ্ঠুর সত্য। নিজের
অংশের প্রতি আমার একটু হলেও মায়া
বেশি জন্মাবে, না চাইলেও। আর
সেটা আমি কখনোই করবোনা। আমি
কখনোই বাচ্চা নিবোনা। আমার
একটাই ছেলে, এটাই আমার জীবন,
এটাকেই আমি আমার অংশ
বানাবো...!"
জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে।
আমি খানিকটা চমকালাম। অপু?
তাহলে কি অপু...? নাসির সাহেব
আমার চমকানো মুখের দিকে তাকিয়ে
থেকে বললেন,
-- জানালা বন্ধ করে দাও, ঠান্ডা
বাতাস ঢুকছে।
জানালা বন্ধ করে আমি অবাক
প্রশ্নবোধক চোখে তাকাই তার দিকে,
তিনি বলেন,
-- অপু আমার প্রথম স্ত্রীর সন্তান।
ডিভোর্স হয়েছে। শুনেছি কোনো এক
বিদেশির সাথে মাখো মাখো প্রেম
ছিলো, সাথে করে নিয়ে গেছে হয়তো
তাকে। আমার জানার ইচ্ছা হয়নি
কখনো আর। দুই বৎসর বয়সের নিজের
অংশটা ফেলে গিয়েছিলো সে,
ফিরেও চায়নি তারপর আর! এমন মা ও
পৃথিবীতে হয়?
আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি, নাসির
সাহেবের চোখভর্তি ঘৃণা! বললেন,
-- ফুলশয্যার রাতে তাসনুভার মুখে
কথাগুলো শুনে আমার মনে হলো, আমি
পৃথিবীর সবচেয়ে পরিষ্কার, নিষ্পাপ,
পবিত্র মনের মেয়েটিকে পেয়ে
গিয়েছি, জীবনে আর কিছুই চাওয়ার
নেই বিধাতার কাছে! এতো সুখ কেন
জীবনে? অপুর কাছে "মা" শব্দটার
তেমন কোনো অর্থ ছিলোনা
এতোদিন। এখন সে অর্থ খুঁজে পেলো।
মা মানে হচ্ছে মায়া! প্রচন্ডরকম
বেশি পরিমাণের মায়া। অপু মা
বলতেই পাগল, এই মা তাকে একমুহূর্ত
চোখের আড়াল করেনা। পাগলের মতো
ভালোবাসে। বাবা মা খুব খুশি। আমি
কাজে ফিরে আসি, মন পড়ে থাকে
গ্রামে। মাস শেষ হওয়ার আগে গ্রামে
ছুটে যাই। কি এক টান। মা ছেলে কে
দেখে বুক ভরে যায়। একটি মেয়ে, কি
এমন ভালোবাসার টানে "পর" শব্দটা
কে "আপন" করে তোলে আমার জানা
নাই। পৃথিবীতে এমন মা ও বুঝি
আছে..?
নাসির সাহেবের চোখে একরাশ
ভালোবাসা। ছেলেকে প্রচন্ড
ভালোবাসেন তিনি। আর ঠিক একিই
কারণেই বৌকে তার থেকেও বেশি
ভালোবাসেন। আমি পরেরটুকু শোনার
অপেক্ষায় রইলাম, নাসির সাহেব
ডানপাশের সিটে রাখা তার
বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছেন।
কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরলেন আমার
দিকে, তারপর বললেন,
-- অপুকে নিয়ে তাসনুভার পাগলামি
ছিলো দেখার মতো। অপুর কোনোদিন
যদি একটু গা গরম ও হয়, তাসনুভা
বাড়িতে পুরো মেডিকেল টিম নিয়ে
আসতো। এককথায় অপু যেন ছিলো তার
শরীরেরই একটা অংশ, যে অংশে একটু
ব্যথা লাগলেও পুরো শরীর সে ব্যথা
অনুভব করতে পারতো। আমি বাড়ি
আসলেই উঠোনে রাতের অর্ধেক পর্যন্ত
আসর জমতো। আমি, অপু, তাসনুভা,
বাবা, মা! ঐ আসরে ফুটবলের গল্প
আসতো, নাম নিয়ে ধাঁধা বলা হতো,
অপুর স্কুলের গল্প আসতো..! সে আসরে
এক রাতে অপু আমাদের সবাইকে একটা
ধাঁধা জিজ্ঞেস করলো, ধাঁধাটা হচ্ছে,
সাত অক্ষর দুই শব্দের এমন একটা নাম
বলতে হবে যেটা উল্টো দিক থেকে
পড়লেও একিই নাম হয়! আমি জানতাম,
উত্তর টা। এটা হচ্ছে, "রমাকান্ত
কামার!" বাবা মা উত্তরটা
জানতোনা। তাসনুভা অপুকে কোলে
নিয়ে বসেছিলো, শাড়ির আঁচল দিয়ে
মুড়িয়ে, বাইরে ঠান্ডা, অপুর যাতে
অল্প একটু ও ঠান্ডা লেগে না যায়। সে
ও উত্তরটা জানতো, কিন্তু আমি বলতে
যাবো উত্তরটা, ঠিক তখন তাসনুভা বাঁ
হাত দিয়ে আমার কোমরে একটা
চিমটি দিলো, তারপর চোখ দিয়ে চুপ
থাকতে ইশারা করলো। তারপর হতাশ
গলায় বললো, "ইশশ.. এতো কঠিন ধাঁধা
আমরা পারি? কেউ ই তো পারছিনা।
তোর বাবা কে দেখ, এত্তো বুদ্ধি তার
মাথায়, অথচ সে ও পারছেনা।
সবাইকে বোকা বানালি। এখন প্লিজ
বল উত্তর টা কি। উত্তর না জানা
পর্যন্ত যে আমার ঘুম হবেনা, প্লিজ...!"
তাসনুভার মুখে কৃত্রিম দুঃশ্চিন্তা।
অপুর মুখ হাসি হাসি, বড়দের বুদ্ধির
খেলায় হারিয়ে দেওয়ার একটা মজা
আছে। আমি মনে মনে হাসি। একটা
ছোট্ট বাচ্চাকে প্রতিটা মুহূর্ত,
প্রতিটা সেকেন্ডে ও কি করে খুশি
করা যায়, সেটা নিয়েও সে সচেতন।
অজানা এক খুশিতে আমার বুকটা ভরে
যায়! পৃথিবীতে এতো সুখ ও বুঝি
আছে?
.........
সীতাকুণ্ড পার হচ্ছি, নাসির সাহেব
মোবাইল বের করে স্ক্রীনে মাথা
নিচু করে কি যেন দেখছেন। ফোন
আসছে সম্ভবত। কানে লাগিয়ে
বললেন,
-- হ্যাঁ যাচ্ছি আমি। এই তো
সীতাকুণ্ড পার হইছি..। হ্যাঁ, হ্যাঁ..
নিয়েছি। আগেও তো বলেছি, নিয়েছি
নিয়েছি...! এইতো আমার ডানপাশে
রেখেছি, নাহ... কেউ হাত ও দেবেনা।
আচ্ছা, গিয়ে আমি ঠিক ফোন দেবো।
কেমন? তুমি ঔষুধ খাইছো? আচ্ছা, মা
কে দাও দেখি...! (একটু অপেক্ষার পর)
হ্যাঁ মা... ঔষুধ খাওয়াইছো সকালের
টা? আচ্ছা। আচ্ছা..! এখন ঘুমোতে
বলো ওকে..। রাখছি..!
আমি চুপচাপ নাসির সাহেবের কথা
শুনছি। একটু অবাক হচ্ছি। কথা শুনে
মনে হচ্ছে, তার স্ত্রী, বাবা মা,
শহরেই থাকছেন। তবে তিনি কেন
গ্রামে যাচ্ছেন? কোথায় যাচ্ছেন?
কি নিয়ে যাচ্ছেন? নাসির সাহেব
বলতে শুরু করলেন আবার,
-- আমার ছেলে আমার মতোই। ফুটবল
পাগল। হয়তো আমার থেকে একটু বেশি
ই। তাসনুভা স্কুলটাইম ছাড়া আর
একমুহুর্তও তাকে চোখের আড়াল
করেনা। ছেলেকে আমিই চুপিচুপি বলে
আসতাম, "স্কুলে খেলিস ফুটবল, টিমে
নিয়মিত খেলবি। তবে স্কুল টাইমে।
প্রয়োজনে দু'য়েকটা ক্লাস মিস
দিবি। স্কুলে প্রত্যেকটা ক্লাসে
হাজিরা দিতে হবে এমন কোনো কথা
নাই। খেলবি, খেলা দেখবি, টাইম
শেষ, সবার সাথে বাড়ি ফিরবি। তোর
মা যেন না জানতে পারে।" অপু
হাসে। ভাবে, সে হয়তো পৃথিবীর
সবচেয়ে সুখী সন্তান। সেরা বাবা,
সেরা মা পেয়েছে। বিধাতা, প্রচন্ড
সুখী মানুষদের প্রচন্ড সুখ কেড়ে নেন
একটা সময় পর। অবশেষে আমার ও সেই
সময় হয়ে আসলো...!
বাসের সামনের দিকে আবার
চিৎকারের আওয়াজ শুনলাম। ঐ বৃদ্ধা
আর অসুস্থ তরুণী। একটু অপেক্ষা করতেই
পরিষ্কার বোঝা গেলো, এবারের
ঝগড়া টা ঠিক উল্টো কারণেই। এইবার
ঝগড়া বেঁধেছে, বৃদ্ধা জানালা বন্ধ
করতে চাচ্ছেন আর তরুণী খুলে রাখতে
চাইছেন তাই! আমি মজা পেলাম
ভীষণ। বৃদ্ধার ঠান্ডা লাগছে ভীষণ,
তাই জানালা বন্ধ করে দিতে
চাইছেন। কিন্তু তরুণী গায়ে বাতাস
লাগিয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন
আধাঘন্টায়, তাই জানালা ইচ্ছা করেই
খুলে রাখতে চাইছেন যাতে বৃদ্ধা কষ্ট
পাক। কি আজব কান্ড! নিজে কষ্ট
পেলেও অন্যজনের কষ্ট হবে জেনে
আনন্দ পাচ্ছে মেয়েটি, মেয়েটির উপর
আমার ভীষণ রাগ হলো এইবার। নাসির
সাহেবের গল্পে একটা মোড় আসছে
যখন, তখন আমরা সিতাকুন্ড পার হয়ে
যাচ্ছি! নাসির সাহেব বললেন,
-- তাসনুভার মানসিক সমস্যা ধরা
পড়লো। আমি ওকে নিয়ে শহরে চলে
আসলাম। অপুকে রেখে। তাসনুভা ভীষণ
কাঁদলো। বারকয়েক জ্ঞান হারালো।
অপু কাঁদলোনা। চুপচাপ। একফোঁটা জল
ছিলোনা ছেলেটির চোখে। যেন
কিছুই হয়নি, কিছুই ঘটেনি, কাউকেই
চিনেনা সে। মুখ দিয়ে একটু আওয়াজ
পর্যন্ত করলোনা। যখন ওকে একা রেখে
চলে আসছি আমরা, একবার ফিরেও
চায়নি সে। আমরা চলে আসি শহরে।
এইখানে বাসা নিই। বাবা মা কেও
নিয়ে আসি। অপু একা থেকে যায়। কি
শক্ত ছেলে আমার। এতোটুকু ভয়
পায়নি। আমার নরম ভীত আদুরে
ছেলেটি হুট করে কেমন যেন চুপচাপ,
নিরব, শক্ত হয়ে উঠে...!
হেল্পারের আওয়াজ শোনা গেলো,
নিজামপুর নিজামপুর...! কখন যেন
এতোটা পথ চলে আসলাম, টেরই পেলাম
না। নাসির সাহেব চুপ করে আছেন,
ডানদিকে তাকিয়ে। ওখানে একটা
বাক্স। আজব তো! বাক্সের ভেতরে
আছেটা কি? ওদিকে তাকিয়ে থেকে
তিনি বললেন,
-- এই দিনে একটা গিফট নিয়ে যাই
আমি অপুর কাছে। সারা বৎসর
আমাদের দেখাই হয়না। গিফট পেয়ে
খুশি হয় কিনা বুঝতে পারিনা সে।
ছেলেটা আগের মতোই রয়ে গেছে,
একটুও পাল্টায়নি। চুপচাপ। আমার
কান্না পায়। তাসনুভা ছেলেকে ভয়
পায়, ছেলের সামনে দাঁড়াতে
পারেনা। আমাকেই আসতে হয়, এই
গিফট টা নিয়ে। একটা বাক্স! ভেতরে
একটা ফুটবল। ছেলেটা ফুটবল বড্ড
ভালোবাসে...!
.......
আমায় হতভম্ব অবস্থায় রেখে নাসির
সাহেব আমার চোখের সামনে দিয়ে
বাক্সটা নিয়ে নেমে গেলেন। আমি
হা করে তাকিয়ে থাকলাম। কিছু
বলার অবস্থা ছিলোনা। এটা কেমন
গল্প? কিছুই তো বোঝা গেলোনা।
তাসনুভার মানসিক সমস্যা বুঝলাম,
কিন্তু তার জন্যে অপুকে কেন গ্রামে
একা থাকতে হচ্ছে? তাসনুভা কেন ভয়
পাচ্ছে ছেলেটিকে? প্রচন্ডরকম
ভালোবাসে ছেলেটিকে সে। আমার
ভাবনার মাঝপথেই বাস আবার চলতে
আরম্ভ করলো, হেল্পার একটু উঁচু গলায়
শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করলো,
-- আর কেউ আছেন...? বড়তাকিয়া..
বড়তাকিয়া...?
আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো,
কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি আমি।
মনেই তো ছিলোনা, আমি ও তো
এখানে নামবো। বড়তাকিয়া।
তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। নামার
আগে বাসের সামনের সিটে একটা
দৃশ্য দেখলাম। অসুস্থ তরুণী ঘুমাচ্ছে,
বৃদ্ধার কাঁধে মাথা দিয়ে। বৃদ্ধা পরম
মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে
দিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- ঘুমুচ্ছে। মাথাটা ঐ দিকে পড়ে
যাচ্ছিলো, এজন্যেই...
আমি মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে নেমে
পড়লাম, মনটা ভালো হয়ে গেলো।
নাসির সাহেবের গল্প থেকে বের
হতে আমায় বাসের এই দৃশ্যটি অনেক
হেল্প করলো। কিন্তু আবার গল্পটা
মাথায় ভর করলো কিছুক্ষণ পর। কি এক
গল্প শুনলাম। আজব! সি এন জি নিয়ে
বাড়ির পথ ধরলাম।
অনেকদিন পর গ্রামে ফিরছি,
পড়াশোনার চাপে গ্রামে আসাই
হয়না। ফোনে বাবার বকুনি শুনতে
শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে,
বাড়ি আসার জন্যে। সি এন জি
আবুতোরাব পর্যন্ত যাবে, সিরিয়ালের
সি এন জি। একজনের ভাড়া বারো
টাকা করে। আমরা পাঁচ জন, যদিও
চেনা জানা কেউ নেই। আমি বাইরে
তাকিয়ে আছি, কয়েকটা মোড় পার
হতেই একটা জায়গায় চোখ থমকে
দাঁড়ালো। "অন্তিম।" ১১ই জুলাই এক
মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ
হারানো পঁয়তাল্লিশ জন স্টুডেন্টের
স্মৃতি রক্ষার্থে এটা বানানো
হয়েছে। ঐ জায়গাটায় যেখানে
দুর্ঘটনা টা ঘটেছিলো। আমি ঐদিকে
হা করে তাকিয়ে থেকে সি এন জি
থামাতে বললাম ড্রাইভার কে।
"অন্তিম" এর সামনে একটা ভদ্রলোক
দাঁড়িয়ে আছেন, চুপচাপ। কালো রঙের
শার্ট গায়ে, হাতে বাক্স। বাক্সের
ভেতরে একটা ফুটবল। ওহ মাই গড! ওহ
মাই গড! নাসির সাহেব। তাহলে কি
অপু...?? ওহ মাই গড! আমি সি এন জি
কে চলে যেতে ইশারা করে কাঁপা
কাঁপা পায়ে এগোলাম সামনে। আমার
পা সামনে চলতেই চাইলোনা। নাসির
সাহেবের পাশে এসে দাঁড়াতেই
আমার দিকে না তাকিয়ে তিনি
কাঁপা স্বরে বললেন,
-- অপুর জন্মদিন আজ। প্রত্যেক
জন্মদিনে একটা করে ফুটবল দিই আমি
ওকে। আমার ঘরভর্তি ফুটবল। ছেলেটা
ফুটবল বড্ড ভালোবাসে। ঐদিন ও ফুটবল
খেলা দেখতে গিয়েছিলো, স্কুল
থেকে, আরো কিছু বন্ধুর সাথে। এতদুর
পর্যন্ত জীবিত ফিরে, তারপরে লাশ
হয়ে যায়! চুপচাপ। গলার ভেতরে ঢুকে
যাওয়া কাঁদা, খোলা চোখ..! আর
কখনো কথা বলেনি আমার ছেলেটি।
তাসনুভার মানসিক সমস্যা দেখা
দেয়, মাঝে মাঝে গভীর রাতে অপুর
কবরের মাটি খুঁড়তে শুরু করে চুপিচুপি
এসে। এখানে তাকে আর রাখতে
পারিনা আমি। শহরে নিয়ে যাই।
ছেলেটা পড়ে থাকে একা, এখানে।
আমি বছরের একটা দিন একটা ফুটবল
রেখে যাই এখানে। এর আগের বৎসর
ফুটবল রেখে চলে যাওয়ার সময় এক
অপুর্ব দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয় আমার।
ঐ যে পাশের বাড়ি তে একটা ছেলে
থাকে, অপুর থেকে একটু কম বয়স হবে।
এখানে যে ফুটবল টা রাখি, ছেলেটা
ফুটবলটা নিয়ে যায় পাশের ঐ মাঠে,
তারপর অনেকক্ষণ পর্যন্ত একা একা
খেলে। আমি এখানে বসে থেকে
খেলা দেখি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকি, চোখে জল চলচল করে.. মাঝে
মাঝে মনে হয় অপু দৌড়াচ্ছে.. বলে
লাথি দিচ্ছে.. চিৎকার করছে..!
আমি চুপ করে থাকি, চোখে জল জমে।
নাসির সাহেব উপরে তাকান, উদাস
গলায় বলেন,
-- অন্তিম। ভাগ্য, পরিণতি, সমাপ্তি।
ঐ তো, ঐখানে ইট পাথর সিমেন্টে
বাঁধানো এই শব্দগুলোয় আমার অপু
মিশে আছে। ভাগ্যে, পরিণতি আর
সমাপ্তিতে..! পৃথিবীতে কত মানুষেরই
সমাপ্তি হয় নিরবে, এরা কেন থকথকে
কাদায় হাত পা ছুঁড়ে হাতড়িয়ে
হাতড়িয়ে জীবন খুঁজেছিলো..? অল্প
একটু জীবন, এক চিমটি অক্সিজেন...!
আমার আদুরে ছেলেটির সামান্য গা
গরমে যে বাড়িতে মেডিকেল টিম
বসতো, ওখানে ঠান্ডা লাশ টার
জন্যে কোনো ডাক্তার আসেনি..! এই
অন্তিম একটা চটপটে ফুটবল পাগল
ছেলেকে চুপচাপ লাশ বানিয়ে দেয়..!
কেন..? এমন অন্তিম শুধু এদেরই কেন
হলো বলতে পারো ভাই...?
নাসির সাহেবের চোখে জল। কি
আশ্চর্য! জলের ফোঁটা টা গাল গড়িয়ে
শার্টের বামদিকের কলারের ঐ
জায়গায় গিয়ে পড়লো, যেখানে চুন
লেগেছিলো। আমি অবাক হয়ে কড়া
দুপুর রোদে কালো রঙের শার্টের
কলারে লেগে থাকা চুনে টপ করে পড়ে
চকচক করা অশ্রুফোঁটা দেখি। সে এক
অদ্ভুত দৃশ্য! নাসির সাহেবের ভেজা
গলার শেষ স্বর শুনতে পাই আমি,
-- ছেলেটা ফুটবল বড্ড
ভালোবাসতো....!
দু'জন দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ অনেকক্ষণ,
সামনে "অন্তিম" আর মাথার উপরে
দুপুর..! আশেপাশে জমাট বাঁধা একটা
গল্প... আমার আফসোস হলো ভীষণ..
গল্পের শেষ টা না জানাই বোধহয়
উচিৎ ছিলো..!