PopUp

Monday, September 11, 2017

গল্প : আকুতি

গল্প : আকুতি
.
-আপা আমাকে এমন একটা ঔষুধ দিবেন যেটা খেলে ধীরে ধীরে কয়েকদিনের ভিতর মরে যাব। যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমি আত্মহত্যা করেছি।
- মানে? 
- মানে আমি আত্মহত্যা করতে চাই কিন্তু আত্মহত্যা করলে অনেক সমস্যা হয় লাশ নিয়ে। রুবি আপার মারা গেলে তার লাশটা পোস্টমর্টেম করে যদিন আনলো আমিও দেখতে গিয়েছাল। উহ! কি বিভৎস দৃশ্য! সবাই নাকে কাপড় চেপে ধরে পঁচা মাংসগুলিকে একরকম মাটি চাপা দিয়েছিলো। তাই এমন ঔষধ চাই যেটা খেলে হয়তো প্রেশার বাড়বে বা মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ ঘটে মারা যাব। মনে হবে স্বাভাবিক মৃত্যু। 
১৭ বছর বয়সী একটা মেয়ের কাছে এমন কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম! জীবনটাকে কী ভাবে এরা?
- তুমি আত্মহত্যা করতে চাও কেন?
- সেটা অনেক কষ্টের এবং লজ্জার কথা আপা। 
- সেই কথাটাই আমি শুনতে চাই।
তারপর অনেক সংকোচ নিয়ে মেয়েটি বলল,
- কয়েকদিন আগে দুপুর বেলা কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা ছেলে আমাকে মুখে ক্লোরোফর্ম মেশানো রুমাল চেপে ধরে জঙ্গলে নিয়ে রেপ করে। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে সেই জঙ্গলের মাঝে আবিস্কার করি। একথা কাউকেই বলতে পারিনি। প্লিজ .. আপনি আমাকে একটা ঔষুধ দিন। আমি আগে আত্মহত্যাকে খুব ঘৃণা করতাম কিন্তু এখন এছাড়া উপায় দেখছি না। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। এক অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে। মনে হয় আমার দেহটা একটা অপবিত্র কিছু সেটা আমি বহন করে চলেছি । 
- একটা দেহ ভুলক্রমে বা দুর্ঘটনাবশত কোন পুরুষের ভোগের সামগ্রী হলেই তা অপবিত্র হয়ে যায় না। আমাদের শরীরের কোন অঙ্গে যদি ঘা হয় আমরা সেই অঙ্গটা কেটে ফেলতে চাইনা। চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলতে চাই। একান্তই যদি না পারি তাহলে সেই অঙ্গটা কেটে ফেলি কিন্তু তাই বলে পুরো শরীরটাকে ধ্বংস করে ফেলি না। 
- আমার মনের অবস্থা আপনাকে বোঝাতে পারবো না আপা। কতটা কষ্ট পেলে মানুষ নিজেকে শেষ করে দিতে চায়।
আমার এক আত্মীয় গাড়ি দুর্ঘটনায় দু'টি পা হারিয়েছে। এখনোও পঙ্গু হাসপাতালে আছে। আমি গাজিপুর থেকে দুইদিন পরপর গিয়ে তাকে দেখে আসি। আজকেও যাব। মেয়েটি আমার পরিচিত। পাশেই ওদের বাড়ি। আমি বললাম,
- তোমাকে সব বোঝাব। তুমি আমার সাথে এক জায়গায় যাবে?
- যাব আপা
- ঠিক আছে তাহলে তোমার মা'কে বলে এখনি চলে আসো।
.
ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল। গত দুই মাস ধরে এখানে এসে আমি আমার নিজের জন্য মন খারাপ করা ভুলে গেছি। করিডোর দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি। আমার ভাবনাগুলো কখনোও সাজানো গোছানো হয় না। আমার জীবনের মতোই এলোমেলো হয় । দুইদিন আগে যেদিন এলাম রাজশাহী থেকে এক রোগী এসেছে। সি এন জি উল্টে গিয়ে কোমর থেকে নিচের অংশ থেতলে গেছে। ভাগ্যক্রমে একটা পা বেঁচে গেলেও আরেকটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সেই লোকটার বাঁচার আকুতি দেখে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিলাম সেদিন। আমারতো কষ্ট বলতে একটাই , পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তান না পেয়ে স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। গত পাঁচ বছর যাবত প্রতিটা রাত কেটেছে আমার বালিশ ভিজিয়ে। একেক দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী আমার রাতের জানালা। নির্ঘুম রাতে জানালার পাশে বসে কাটিয়ে দিতাম পুরোটা রাত। কিন্তু গত দুই মাস থেকে আমার নিজের কষ্টগুলি চাপা পড়ে গেছে। যখনই ভাবি আমার অনেক কষ্ট তখনই চোখের সামনে ভেসে আসে হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে কাতরানো অসহায় মানুষের মুখ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অসহায় নারী আর শিশুদের চিৎকার! আমি ভুলে যাই আমার কষ্টগুলি । আমার তো সব আছে শুধু সন্তান নেই কিন্তু চোখের সামনে নিজের সন্তানকে মৃত্যু হতে দেখেও অনেক নারীকে বেঁচে থাকতে হয়। কতটা কষ্ট তাঁদের ! কই তাদের কেউ তো আত্মহত্যা করে না!
.
আমি আর রাহেলা এসে দাঁড়ালাম একটা বেডের কাছে। রোগীটি আজই এসেছে। ১৫-১৬ বছরের একটা মেয়ে, সারা শরীরে ধারালো কোপের দাগ। জানতে পারলাম শত্রুতার জের ধরে এই মেয়েটিকে এমন ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। মেয়েটি অজ্ঞান ছিলো , একটু পরই তার জ্ঞান ফিরে আসলো । চোখ মেলেই চিৎকার জুড়ে দিলো 'আমাকে মেরোনা, আমাকে বাঁচাও' । মেয়েটির চোখে মুখে স্পষ্ট আতংকের ছাপ। পাশের মহিলাটি তাকে জড়িয়ে ধরলো কাঁদতে কাঁদতে 
- দেখ মা, আমি । তোকে হাসপাতালে এনেছি। তোকে কেউ মারতে পারবে না।
বলেই মহিলাটি কাঁদতে লাগলো।
আমি রাহেলাকে নিয়ে সারা হাসপাতাল ঘুরতে লাগলাম। রোগীর আর্তচিৎকারে ভরে গেছে প্রতিটা ওয়ার্ড কিন্তু কেউই মরতে চায়না। সবার চোখে মুখেই বাঁচার আকুতি। সুন্দর পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায়। আগামিকালের নতুন সূর্যটা সবাই দেখতে চায়। একসময় রাহেলা আমার হাত চেপে ধরলো।
- চলেন আপা, আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
- এবার বলো , তোমার কষ্টটা কি এদের চেয়ে বেশি? আমার কথা তো সবই জানো । এই যে গত পাঁচ বছর ধরে আমি বাবার বাড়ি থাকছি , প্রতিটা রাত আমার ছটফট করে কেটে যায়। অথচ আমি মরতে চাই না। আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে। ভোরের প্রথম সূর্যটা দেখার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে, পাখির ডাক শোনার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে, সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে, চাঁদটা দেখার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে। মানুষের জন্য কিছু করতে পারবো, এই ভেবে বাঁচতে ইচ্ছে করে। অনেকেই আবেগের বশে ছোটখাট কষ্টকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুর সাগরে অথচ তারা বোঝে না , নিজের জন্য না হোক অন্তত বেঁচে থেকে কারো মুখে হাসি ফোটানো যায়। 
- আপনি আমার ভুল ভেঙ্গে দিয়েছেন আপা। সত্যি আপা এমন করে কোনদিন ভাবিনি। বেঁচে থাকার জন্য সবগুলো সুখই লাগবে এমন কিছু নয়। অনেক কষ্ট থাকলেও একটু সুখের জন্য, একটা ভালো কিছুর জন্যও বেঁচে থাকা যায় , এই প্রথম অনুভব করলাম। আমিও বাঁচতে চাই আপা।

0 comments:

Post a Comment