PopUp

Sunday, September 10, 2017

গল্পঃবোঝা


গল্পঃবোঝা

সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা মেয়েটি হয়তো জানে না,কি নিষ্ঠুর "পৃথিবী" নামক রঙ্গ মঞ্চে এসেছে...মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবার দিকে...তাকিয়ে দেখছে অচেনা মানুষগুলোকে, হঠাৎ কেউ একজন মেয়েটিকে কোলে তুলে নাম দিলো, "নিলিমা"। এই নাম দেওয়া মানুষটি আর কেউ'ই না, তিনি নিলিমার বাবা "নীল বাবু" লোকে ভালোবেসে নীলু বলে ডাকে। নীলু বাবু অন্যের জমিতে খায়ফর্মাস খাটে...
"নিলিমা" তাদের একমাত্র সন্তান... সবাই আশা করেছিলো একটা পুত্র সন্তান হবে, কিন্তু সবার সব আশা তো পূরণ হয় না...তাদের ছোট্ট সোনার সংসার আলো করে আসলো, "নিলিমা" নামের মেয়েটি...
কে জানতো এই ছোট্ট ফুটফুটে কালো রঙ এর "নিলিমা" নামের মেয়েটি এই "পৃথিবী" নামক রঙমঞ্চের মানুষদের কাছে বোঝা হয়ে দাড়াবে...!
এই মুহূর্তে নিলিমাকে সবাই অনেক আদর করছে... কেউ কেউ কোলে তুলে চুমু খাচ্ছে, কেউ আবার নাকে নাক ঘষে দিচ্ছে...
নিলিমার বিধবা বৃদ্ধ ঠাকুমাকে দেখলাম,নিজের গলা থেকে একটা সর্ণের চেইন খুলে নিজের নাতিনের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করলো...
সবার মুখে সেদিন একটা হাসির রোল পড়ে গেলো...
.
পরেরদিন নিলিমার বাবা "নিলু বাবু" নিজে বাজার থেকে মণ্ডামিঠাই কিনে এনে সকলকে মিষ্টিমুখ করালো...
.
এরপর দিন যায় মাস যায় নিলিমা বড় হতে থাকে আর তার চঞ্চলতা বাড়তে থাকে...সাথে বাড়তে থাকে নিলিমার বাবা-মায়ের চিন্তা...
.
দেখতে দেখতে "নিলিমা" নামের মেয়েটির বয়স পাঁচ বছর হয়ে গেলো... নিলিমা এই মুহূর্তে তাদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কুরোচ্ছে... মনে হয় মালা গাঁথবে... গ্রামের মেয়েরা সাধারণত মালা গেঁথে তা দিয়ে সাজতে অনেক পছন্দ করে, নিলিমাও এর ব্যতিক্রম নয়...
রান্না ঘর থেকে নিলিমার মা,
--কিরে মা, ভাত খেয়ে যা...
--না মা, আরেকটু পরে খাব...
--কেন...?
--বাহ্ রে দেখতে পাচ্ছো না, ফুল কুরোচ্ছি... মালা গাঁথতে হবে না...!
--মালা না হয় খাওয়ার পরে'ই গাঁথিস...
--না মা, খাওয়ার পর গাঁথলে ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে...
--শুকোবে না...!খেতে তোর যে অনেক সময় লাগে...
--সেই জন্য'ই তো কইছি, মালা গেঁথে তারপরে'ই খাবো...
--কিন্তু স্কুলের সময় যে প্রায় এগিয়ে এলো...
--আজ আর স্কুলে যাব না...
--কেন...!
--এমনি...
--এমনি কেন...! যাইতেই হবে...
--না যাব না...
--বললাম না,যাইতেই হবে...
এই বলে'ই নিলিমার মা নিলিমার হাত ধরে টেনে হিচরে নিয়ে গেলো... আর ফুল গুলো উঠোনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রইলো...
নিলিমাকে খাওয়ানোর পর পাঠশালায় পাঠানো হলো... মেয়েটা যাবেই না, তবুও মায়ের রাগি কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে যেতে হলো...
মাস্টার কাকুর বাড়ি নিলিমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়...মাত্র ৫ মিনিটের পথ, নৌকায় করে যেতে যতটুকু সময় লাগে আর কি...!
.
এমা...! ১০ মিনিট পর'ই নিলিমা বাড়ি ফিরে এলো...
মা যখন জিজ্ঞেস করলো,"যাসনি...!" নিলিমা উত্তর দিলো,"গিয়েছিলাম
,কিন্তু মাস্টার কাকু নাকি শহরে গেছে কোন একটা কাজে..."
--আচ্ছা, তাহলে যা পড়তে বস...
--না,এখন পড়বো না...
--তাহলে কি করবি...?
--বিলে যাব শাপলা তুলতে...
এই বলেই এক দৌড়ে চলে গেলো নিলিমা তার বন্ধু পায়েল, শুভ আর দিপালিকে ডাকতে... ওদের নিয়েই বিলে যাবে...
প্রায় ২ঘন্টা পর বিল থেকে ফিরে আসলো...হাতে একগাদা শাপলা,
নিলিমার মা এতো শাপলা দেখে নিলিমাকে বকলো,এতো শাপলা দিয়ে কি করবে...? তাই কিছু শাপলা পাশের বাড়ির বৌদিকে দিয়ে দিলো...
.
শাপলা গুলো থেকে কয়েকটা শাপলা নিলিমা নিলো, মালা বানাবে বলে... শাপলা ফুলের মালা বানানো অনেক সহজ, তাই নিলিমার বেশি সময় লাগলো না.
একটু পর'ই নিলিমার বাবা নিলু বাবু কাজ থেকে এসে নিলিমার কাছে এক গ্লাস জল চাইলো...
নিলিমা একদৌড়ে জল এনে বাবার কাছে দিতে দিতে বললো,"বাবা, আমাকে চুড়ি কিনে দিবা...!"
--হ মা, সামনের হাটে কিনে দেবো...
নিলিমা খুশিতে লাফাতে লাফাতে চলে গেলো, রবি কাকুর পেয়ারা গাছের পেয়ারা পাড়তে... মেয়েটা একটুও সুস্থ হয়ে থাকতে পারে না, সারাক্ষণ এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে টৈ টৈ করে বেড়ায়...
.
কে জানতো এই টৈ টৈ করে বেড়ানো মেয়েটা একটা বড় দুর্ঘটনার শিকার হবে...! মাত্র ৬বছর বয়সে মেয়েটার বাম হাত প্যারালাইজড করে...এতো ছোট বয়সে প্যারালাইজড...! ভাবতেই অবাক লাগে...কিন্তু কি আর করার রোগ তো আর বলে কয়ে আসে না,আর এখান থেকে'ই নিলিমার আরোও একটি জীবন শুরু...যে জীবন কষ্টের, বড়'ই কষ্টের... বাড়িতে সবসময় বসে বসে সময় কাটায়, বাড়ির উঠোনের শিউলি ফুল গুলো দিনের পর দিন পড়ে থাকে আবার পচেও যায়... রবি কাকুর পেয়ারা গুলো এখন আর কেউ চুরি করে না...
শাপলা তুলে এনে এখন আর বলে না, "মা, এই দেখো কতো শাপলা আনছি..."
মেয়েটা একটু আধটু পাঠশালায় যায়, কারণ মেয়েটার বাঁ হাত প্যারালাইজড করছে... মেয়েটার স্বপ্ন অনেকদূর পড়ালেখা করবে, একটা স্কুলের শিক্ষিকা হয়ে গ্রামের বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাবে.
.
মেয়েটার এই শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্নও যে ধ্বংস হয়ে যাবে কে জানতো...! মেয়েটার বয়স যখন ১৩ বছর, মেয়েটার বাবা পরলোকে পাড়ি জমায়...সেই থেকে'ই সংসারের হাল নিলিমাকেই ধরতে হয়...মায়ের সাথে সেই ভোরে ক্ষেতে কাজ করতে যায়, আর আসে সন্ধ্যায়...
এভাবে প্রায় কেটে গেলো আরোও এক বছর... এদিকে গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী নিলিমার বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে... সাধারণত গ্রামে ১৪-১৫ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়...
এদিকে নিলিমার মায়ের চিন্তাও বাড়তে থাকে, মেয়েটা কালো হলে কি হবে দেখতে মোটামুটি ভালো'ই...
পাত্রপক্ষের পছন্দ হয় কিন্তু হাতের সমস্যার কারণে কেউ বিয়ে করতে রাজি না... তারা বলে,"হাত না থাকলে সংসারের কাজ করবে কে...!"
.
অনেকে নিলিমাকে দেখতে আসলো, আবার চলেও গেলো... কিন্তু ওই একটা'ই সমস্যা, হাত...
এখন নিলিমা নিজেকে বোঝা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে...
মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কি জেনো ভাবে... হয়তো ভাবে,"পৃথিবীতে জন্ম নেওয়াটাই তার অপরাধ হয়েছে..."
মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসতো, এখনো ভেজে পার্থক্য শুধু একটা'ই আগে ভিজতো আনন্দে আর এখন ভেজে চোখের জল লুকানোর জন্য...
.
অনেক পাত্র নিলিমাকে দেখার পর কোন একটা পাত্র নিলিমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো,কিন্তু এই বিয়ের মধ্যে একটা শর্ত আছে... পাত্রপক্ষকে দেনাপাওনা হিসাবে ২ লক্ষ টাকা দিতে হবে,
নিলিমার মা কোন কিছু না ভেবে'ই পাত্রকে হ্যা করে দিল...পাত্রকে হাতছাড়া করা যাবে না... পাত্রপক্ষের নাকি অবস্থাসাধীও অনেক ভালো, শহরে থাকে...শহুরে বাবু যাকে বলে আর কি...!
.
এদিকে পাত্রপক্ষকে "হ্যা" বলার পর'ই নিলিমার মায়ের চিন্তা আরোও বাড়তে থাকে... ভিটেমাটি ভিক্রি করে ১লাখ ৭০ হাজার টাকা হয়েছে, আর বাকি আছে ৩০ হাজার...
অবশেষে ঠিক করলো, কড়া সুদে মালিকের কাছ থেকে টাকা ধার আনবে...
.
কোন এক সন্ধ্যা,ঝিঝিপোকার আওয়াজ, মিটি মিটি প্রদীপের আলোয় নিলিমা তার মায়ের কাছে এসে বললো,"মা, এই বিয়ে আমি করবো না, যৌতুক দিয়ে আমি বিয়ে করবো না..."
--কিন্তু মা,পাত্রপক্ষের ব্যাপারে তোর ছোট মামা খোজ নিয়ে দেখেছে, তাদের অবস্থা অনেক ভালো, সেখানে থাকলে তুই অনেক সুখে থাকবি,আর তোর সুখের জন্য যদি নিজেকে প্রাণও দিতে হয় তাও দেবো
--না, আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না...
(কান্না জড়িত কন্ঠে নিলিমা)
--নারে মা,এমন বলতে নাই, সব মেয়েকে'ই একদিন না একদিন বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়...
--আচ্ছা মা,আমাকে কি তুমি বোঝা ভাবো...!
নিলিমার মা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো,"তা কেন হবে মা...!"
--তাহলে যে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছো...!
--এটাই প্রকৃতির নিয়ম রে মা...
--কিন্তু, আমি যৌতুক দিয়ে বিয়ে করবো না...
-- নারে মা, যৌতুক যে দিতেই হবে, না হলে ওরা তোকে নেবে না...
--না নিক, না নিক, আমি তোমার কাছে'ই থাকব...
--তা যে হয়না পাগলি...
...........................................................
অবশেষে নিলিমার বিয়ে ভালোভাবেই সমাপ্ত হলো...
নিলিমার মা পাত্রপক্ষের সব দাবি'ই পূরণ করেছে, নিলিমার বিয়ের সব দায়িত্ব নিয়েছিলো নিলিমার ছোট মামা আর সে দায়িত্ব তিনি সঠিক ভাবেই পালন করেছেন...
.
এখন থেকে নিলিমার নতুন জীবন শুরু...
কিন্তু বিয়ে হতে না হতেই শাশুড়ির অত্যাচার সইতে হচ্ছে নিলিমাকে...
উঠতে বসতে খোটা দেয়,"বসে বসে খাওয়া...!"
অথচ নিলিমা তার ডান হাত দিয়েই তার সাধ্যমত কাজ করে...তবুও শাশুড়ির হবে না...তিনি চান সব কাজ'ই নিলিমা করুক, কিন্তু মেয়েটা যে এক হাত নিয়ে পেড়ে ওঠে না...!
খাওয়া নেই ঘুম নেই, চোখের নিচে কালি জমে গেছে, এদিকে শাশুড়ির আক্রোশ কিছুতেই মেটে না, মেয়েটাকে ঠিক মতো খেতে দেয় কিনা তাও সন্দেহ...
দিন দিন কেমন জেনো কংকালসার হয়ে যাচ্ছে...
এখানেও নিলিমা নিজেকে বোঝা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে... আর তার শাশুড়ি তাকে মাঝে মাঝে'ই গালাগাল দিয়ে বলে, "ডুবে মরতে পাড়িস না...!" নিলিমার স্বামীকে নিলিমা সব কিছু বলে... তিনি বলেন," মায়ের এখন বয়স হয়েছে, তাই কিছু মনে করো না..."
নিলিমার শাশুড়ি খারাপ হলে কি হয়েছে! তার স্বামী অনেক ভালো, অনেক ভাগ্য করে এমন জামাই পাওয়া যায়...
.
বিয়ের তিন বছরের মাথায় নিলিমার কোল জুরে আসে ফুটফুটে একটা পুত্র সন্তান, তার নাম রাখা হলো, "দিপু"
.
দিপুর বয়স যখন ২বছর তখন তার ঠাকুমা পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে...
এদিকে দিপু বড় হতে থাকে...
দিপুর যখন অনার্স-২য় বর্ষে,তার বাবা গত হলেন...
.
..........................................................
ছোট্ট দিপুটা আজ সত্যিই বড় হয়ে গেছে,
এখন সে একটা ব্যাংকে চাকরি করে... নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে... তাই তার মা ঠিক করলো, ছেলেকে বিয়ে দেবে...
সন্ধ্যার পর মা দিপুর রুমে এসে,
--বাবা,বলছিলাম কি এখন তো তুই নিজের পায়ে দাড়াইছিস, এখন একটা বউমা নিয়ে আয়... তারপর নাতি-পুতির মুখ দেখেই আমি শান্তিতে মরতে পারবো...
--মরার কথা মুখেও আনবা না...
--তা বললে কি হয় রে বাবা...! বয়স হয়ে গেছে,কিজানি কবে চলে যাই...! তুই বিয়ে কর বাবা...তোর দূর সম্পর্কের ছোট মামা একটা মেয়ে দেখেছে, কাল মামার সাথে মেয়েটাকে দেখতে যা বাবা...
--আচ্ছা যাব...
............................................................
মেয়েটাকে দিপুর পছন্দ হয়েছে,বনেদি ঘরের মেয়ে,কোন কিছুর'ই অভাব নেই...
আজ ওদের বিয়ে...
দিপুর মা দিপুকে বললো,"তোর বাবা বেচে থাকলে অনেক খুশি হতো..."
.
.
.
.
.
দিপুর বিয়ের ৩বছর পর,,
--বৃদ্ধ লোকটি ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে...তিনি এখন প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মৃত্যু কামনা করে...এই শেষ বয়সে এসেও শান্তি নেই...
তার বৌমা সবসময় তাকে বোঝা ভাবে...
মাঝে মাঝে তার বৌমা তাকে "বিদ্ধাশ্রম"
নামক জেলখানায় চলে যেতে বলে,কিন্তু নিলিমা যায় না... অনেক বছরের স্মৃতি জমে আছে এই বাড়িটিতে...
.
৮৪ বছর বয়সেও সেই নিলিমা আজও বোঝা...

0 comments:

Post a Comment